রক্ত দেওয়ার পূর্বে যে সকল জরুরি তথ্য সকলের জেনে রাখা প্রয়োজন

রক্ত দেওয়ার পূর্বে যে সকল জরুরি তথ্য সকলের জেনে রাখা প্রয়োজন

“রক্তদান” শব্দটির সাথে আজকাল আমরা প্রায় সকলেই কমবেশি পরিচিত। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে রক্ত সংক্রান্ত অসুখে ভুগছেন বা রক্ত স্বল্পতায় ভুগছেন এমন কাউকে স্বেচ্ছায় রক্ত দেওয়ার প্রক্রিয়াকে রক্তদান বলা হয়।

রক্তদান করা অত্যন্ত মহৎ একটি কাজ। রক্তদানের মাধ্যমে একদিকে যেমন মুমূর্ষু রোগীর জীবন রক্ষা পায়, অন্যদিকে রক্তদাতা  আত্মিক শান্তি ও মন থেকে তৃপ্তি অনুভব করে।

কিন্তু  রক্তদান করার পূর্বে অবশ্যই আমাদের কিছু বিষয় সম্পর্কে জেনে রাখা প্রয়োজন। সঠিক উপায়ে রক্তদান না করলে অনেক ধরনের সমস্যা বা জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে, তাই অবশ্যই সঠিক তথ্য জেনে তবেই রক্তদান করা উচিৎ।

রক্তদান কেন প্রয়োজন এবং রক্তদানের উপকারিতা কি?

দুর্ঘটনায় আহত, ক্যান্সার ও থ্যালাসেমিয়ার মত জটিল রোগে কিংবা সন্তান প্রসব বা অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে একব্যাগ রক্ত জীবন রক্ষাকারী ভূমিকা পালন করে থাকে।

অনেকে রক্তদানকে ছোট কাজ মনে করে থাকেন কিন্তু রক্তদান মোটেও কোন ছোট কাজ নয়, বরং এটি হল পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ও নি:স্বার্থ উপহার।

রক্তদান করা নিয়ে অনেকের মধ্যেই অনেক ভুলধারণা রয়েছে। অনেকে মনে করেন রক্তদান করলে হয়তো তার শারীরিক ক্ষতি হবে, রক্ত বা ওজন কমে যাবে। কিন্তু রক্তদান করলে আসলে শরীরের কোনো ক্ষতিই হয় না, বরং নিয়মিত রক্তদানের ফলে শরীরের নানা ধরনের উপকার সাধিত হয়।

একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, নিয়মিত রক্তদান কয়েক ধরনের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি কমিয়ে দেয়। রক্ত দেওয়ার পরে মানবদেহে লোহিত রক্তকণিকা উৎপাদন বেড়ে যায়৷ যাদের শরীরে লৌহ জমা হওয়ার প্রবণতা রয়েছে, তাদের জন্য  রক্তদান করা খুবই উপকারী। রক্তদান করার ফলে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে যায়, অনেক ক্ষেত্রে রক্তদান ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে রাখতেও সাহায্য করে থাকে।

আমাদের শরীরে হেপাটাইটিস বি, সি, ম্যালেরিয়া, এইডস, সিফিলিস প্রভৃতি রোগের জীবাণু সুপ্ত বা লক্ষণহীন অবস্থায় থাকতে পারে। রক্তদান করার সময় রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে এসব জীবাণু দেহে আছে কিনা তা সহজেই জেনে নেওয়া যায়।

রক্তদান কারা করতে পারবেন এবং রক্তদানের জন্য প্রয়োজনীয় সক্ষমতাঃ

রক্তদান হচ্ছে  প্রয়োজনীয় মুহূর্তে জীবনরক্ষাকারী একটি  প্রক্রিয়া। রক্তদান করার মতো  বা রক্ত দেওয়ার মতো কারো সক্ষমতা আছে কিনা তা কয়েকটি প্রভাবক বা দিকের ওপর নির্ভর করে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বয়স, ওজন, হিমোগ্লোবিনের মাত্রা, রক্তচাপ ও তাপমাত্রা ইত্যাদি ।

 রক্তদান করার  জন্য শর্তসমূহঃ

১. ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী শারীরিক ও মানসিক ভাবে সুস্থ যে কেউ রক্তদান করতে পারবেন।

২. যাদের ওজন ৫০ কেজি বা তার বেশি (কখনো কখনো ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ৪৫ কেজি ওজনের ব্যক্তিও রক্তদান করতে পারেন)।

৩. কোনো ব্যক্তি একবার রক্ত দেওয়ার ৪ মাস পর পুনঃরায় রক্তদান করতে পারবেন।

যারা রক্ত দিতে পারবেন না -

যে সকল ব্যক্তি শারীরিকভাবে দূর্বল ,সাম্প্রতিক সময়ে কোনো সার্জারি  হয়েছে, জ্বর বা কোনো ইনফেকশন আছে, এইচআইভি, ক্যান্সারের জন্য সম্প্রতি চিকিৎসা নেওয়া হয়েছে, যাদের এক বছরের মধ্যে কোনো অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে এবং গর্ভবতী মহিলারা রক্তদান করতে পারবেন না।

রক্তদানের সক্ষম না হওয়ার জন্য আরও কিছু কারণ রয়েছে-

১. যদি রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কম থাকে (রক্তদানের জন্য পুরুষের সর্বনিম্ন ১২গ্রাম/ডেসিলিটার ও মহিলার সর্বনিম্ন ১১গ্রাম /ডেসিলিটার হিমোগ্লোবিন থাকতে হবে)।

২. যদি রক্তচাপ ও দেহের তাপমাত্রা স্বাভাবিক না থাকে, তবে সে অবস্থায় রক্ত দেওয়া যাবে না।

৩. যদি শ্বসনতন্ত্রের কোনো রোগ থাকে, যেমন- হাঁপানি বা অ্যাজমা।

৪. যদি রক্তবাহিত কোন রোগ থাকে, যেমনঃ হেপাটাইটিস বি, সি, জন্ডিস, এইডস, সিফিলিস, গনোরিয়া, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি। এছাড়াও যদি টাইফয়েড , ডায়াবেটিস, হার্টের রোগ, ত্বকের কোন রোগ থাকে, তাহলে রক্ত দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।

৫. গর্ভবতী মহিলা বা ঋতুবতী অবস্থায় রক্ত দেওয়া যাবে না। এমনকি সন্তান জন্মদানের ১ বছরের মধ্যে রক্ত দেওয়া উচিত নয়।

৬. যারা কিছু চিকিৎসা নিচ্ছে যেমন - কেমোথেরাপি, হরমোন থেরাপি, এন্টিবায়োটিক, তাদের ওই সময় রক্ত দেওয়া যাবে না।

৭. যাদের গত ৬ মাসের মধ্যে বড় কোনো দূর্ঘটনা বা সার্জারি হয়েছে, তারা রক্ত দিতে পারবেন না।

রক্তদান করার পূর্ব মুহূর্তের জন্য কিছু পরামর্শ -

রক্তদান করার মানেই হলো নিঃস্বার্থ ভাবে মানুষের উপকার করা, যা নিঃসন্দেহে অনেক ভালো কাজ। কিন্তু  রক্তদান করার পূর্বে আপনাকে ভাবতে হবে যাতে অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে আপনার কোনো ক্ষতি না হয় বা রক্তগ্রহীতার কোনো ক্ষতি না হয়। তাই রক্তদান করার পূর্বে কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে।

১. আপনি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী কিনা, রক্তদান করার পরে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হোন।

২. রক্তদানের ৩ দিন আগে থেকে অ্যাসপিরিন গ্রহন করবেন না।

৩. রক্ত দেওয়ার আগের দিন তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যান।

৪. রক্ত দেওয়ার আগে অ্যালকোহল সেবন বা ধুমপান থেকে বিরত থাকুন।

৫. রক্ত দেওয়ার আগে পুষ্টিকর খাবার খাবেন কিন্তু তৈলাক্ত খাবার, ভাজাপোড়া খাবেন না।

৬. রক্তদানের পূর্বে প্রচুর পরিমাণে তরল পানীয় যেমন -স্যালাইন, ফলের রস, পানি পান করুন।

৭. রক্তদানের ঠিক আগমুহূর্তে খাবার খাবেন না।

রক্ত দেওয়ার পরবর্তীতে করনীয়ঃ

রক্তদানের পরবর্তীতে কি করা উচিৎ তা নিয়ে আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন থাকে। এই অংশে সেই সকল বিষয়গুলো নিয়েই আলোচনা করবো এবং কিছু পরামর্শ প্রদান করবো যেন রক্তদানের পরের সমস্যাগুলো খুব সহজেই কাটিয়ে উঠতে পারেন।

১. রক্ত দেওয়ার পরে হাতের স্ট্রিপ ব্যান্ডেজটা অন্তত কয়েক ঘন্টা রাখুন।

২. প্রচুর পরিমাণে পানি বা স্যালাইন পান করুন।

৩. ব্যান্ডেজ খোলার পর ফুসকুড়ি জাতীয় সমস্যা যাতে না হয় সেজন্য  ওই অংশ সাবান পানি নিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করুন।

৪. রক্তদানের দিন ভারী কোনো কিছু বহন করা, উপরে তোলা, বা ভারী কাজ করা থেকে বিরত থাকুন।

৫. যদি রক্ত নেওয়ার জন্য হাতের ঐ অংশে রক্তপাত হয়, তাহলে হাত সোজা করে, ৫-১০ মিনিট অন্য হাত দিয়ে ঐ অংশ চেপে ধরে রাখুন যতক্ষণ না রক্তপাত বন্ধ হয়।

৬. যদি রক্ত দেওয়ার পরে মাথা ঘোরা বা কোনো শারীরিক অসুবিধা অনুভব করেন, বসে অথবা শুয়ে বিশ্রাম নিন।

রক্ত দেওয়ার পরবর্তীতে কিভাবে সেরে ওঠা যায়-

রক্ত দেওয়ার পরে কিভাবে নিরাপদ থাকা যায়, বা সেড়ে উঠা যায়, তা জানা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রক্ত দেওয়ার প্রক্রিয়া কারো জন্য  অনেক বেশি স্ট্রেসফুল হতে পারে, অনেক সময় কিছু পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, যার ব্যবস্থাপনা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

রক্তদান করার  পরে যদি আপনি ক্লান্ত, মাথা ঘোরা বা দূর্বল অনুভব করেন, ঐদিন আপনার স্বাভাবিক কাজকর্ম থেকে বিরতি নিন, বিশ্রামে কাটান। প্রচুর পরিমাণে পানীয় যেমন ফলের রস, স্যালাইন, ডাবের পানি পান করুন। অ্যালকোহল সেবন থেকে বিরত থাকুন।

যদি তারপরেও অসুস্থতা থেকে যায়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাক্তারের পরামর্শ নিন|

3

Shares
  • 2
  • 1
  • 0
  • 0

Feedback